মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের কন্যারা নিহত হয়েছে এমন দুজন মানুষের সত্যিকার বন্ধুত্বের কাহিনি নিয়েই এই উপন্যাস। এক কথায় বলতে গেলে, গভীরভাবে হৃদয়কে নাড়া দেওয়ার মত উপন্যাস এটি।
১৯৮৫ সালে জেরুজালেম পুরস্কার গ্রহণের সময় মিলান কুন্ডেরা তার বক্তৃতায় উপন্যাসের বিভেদ অতিক্রম করার কথা বলেছিলেন। তার কথা স্পষ্ট করার জন্য তিনি টলস্টয়ের আন্না কারেনিনা থেকে উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, উপন্যাস হল ব্যক্তির কাল্পনিক বেহেশত। এটা এমন এক এলাকা যেখানে কারো কাছেই সত্যের মালিকানা নেই, আন্নার কাছেও না, কারেনিনের কাছেও না, তবে অন্যরা যাতে তাদেরকে বুঝতে পারে প্রত্যেকেরই সেই অধিকার আছে। আন্নারও আছে, কারেনিনেরও আছে।
এই নিশ্চয়তার যুগে, উপন্যাস হল সন্দেহ, অনিশ্চয়তা ও একাধিক সত্যের ঘরবাড়ি।
কলাম ম্যাককান অ্যাপেইরোগোন নামে যে বই লিখেছেন, সেটাকে তিনি বলছেন হাইব্রিড উপন্যাস। এই উপন্যাসের ধরনের মধ্যে স্ববিরোধিতা আছে। কাহিনির মধ্যেও দেখা যায় লেখক কখনো কখনো দুই দিকেই অবস্থান নিয়েছেন। তবে ম্যাককান এর কোনোটিকেই মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অবস্থা বোঝানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেননি।
উপন্যাসের নামটা তিনি নিয়েছেন একটা গাণিতিক টার্ম থেকে। অ্যাপেইরোগোন মানে হল, জ্যামিতিকভাবে অসীম সংখ্যক কোণ আছে এমন একটা বস্তু। কোনো বিরোধপূর্ণ বা দ্বান্দ্বিক অবস্থানকে যখন খুব সরল কিছুতে নামিয়ে আনা হয় তখন সেই ব্যাপারটিকে নতুনভাবে চিন্তা করার জন্য, নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার জন্য অ্যাপেইরোগোন মডেল ব্যবহার করা হয়।
অ্যাপেইরোগোন এর মত হৃদয় স্পর্শ করা উপন্যাসের জন্য এই সময়টা খুব অদ্ভুত। এটা পড়তে পড়তে মনে হয় মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান অবস্থা আসলে এর বয়সের প্রতিচ্ছবি। ৯০ এর দশকে যখন অসলো চুক্তি হয়, মনে হয়েছিল ডিপ্লোম্যাটিক প্রক্রিয়ায় হয়ত একটা দীর্ঘমেয়াদী সমাধান পাওয়া যাবে। অথচ এখন প্রতিটা পক্ষই নিজের নিজের মত একরোখা অবস্থান নিয়েছে, আর এই বিরোধের গণগণে আগুনের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাতাস দিয়ে যাচ্ছেন। এবং এই জরুরি অবস্থাকে ধারণ করেই এই শিল্পকর্ম—এই উপন্যাস লেখা হয়েছে। এবং এই উপন্যাসে এত সুন্দর, বুদ্ধিদীপ্ত ও সহমর্মিতার আখ্যান বর্ণিত হয়েছে বিভ্রম তৈরি হয়েছে যে এই উপন্যাসই হয়ত সবকিছু বদলে দিতে পারে। এটা অবশ্যই উদ্ভট মনে হতে পারে যে যেখানে রাজনীতিবিদেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সংকট নিরসনে ব্যর্থ হয়েছেন সেখানে বলা হচ্ছে একটা উপন্যাস সফল হতে পারে। কিন্তু অ্যাপেইরোগোন এমন একটি বই যেটা কোনো এক যুগে একবারই মাত্র আসে।
এটা ম্যাককানের সপ্তম উপন্যাস। ২০০৯ সালে তার প্রথম উপন্যাস লেট দ্য গ্রেট ওয়ার্ল্ড স্পিন ব্যাপকভাবে সফল হয়েছিল। সেই উপন্যাসটি ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড ও ইমপ্যাক পুরস্কার জিতে নিয়েছিল এবং ৪০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।
দুইজন মানুষের বাস্তব জীবনের বন্ধুত্বকে ভিত্তি করে অ্যাপেইরোগোনের কাহিনি তৈরি হয়েছে। বাসাম আরামিন নামের একজন ফিলিস্তিনী ও রামি এলহানান নামের একজন ইসরায়েলী এই উপন্যাসের দুই মূল চরিত্র। ম্যাককানের বর্ণনায়, “দখল বিরোধী একজন ইসরায়েলী। হলোকাস্ট নিয়ে পড়াশোনা করা একজন একজন ফিলিস্তিনী।”
এই দুই ব্যক্তিকে পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে আসে তাদের নিজ নিজ শোকের ঘটনা। তারা দুজনই তাদের দুই কন্যাকে হারিয়েছেন। ১৩ বছর বয়সী সেমাদার মারা যায় এক আত্মঘাতী বোমা হামলায়, আর ১০ বছর বয়সী আবির নিহত হয় এক ইসরায়েলী সৈন্যের গুলিতে। এই দুজন মানুষ প্যারেন্টস সার্কেলে যোগ দেয়। প্যারেন্টস সার্কেল হল শোকগ্রস্ত কিছু মানুষের তৈরি করা একটা গ্রুপ—তারা এই সংঘর্ষকে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান দিতে চায়। ম্যাককানের ভাষায়, “এটাই তাদের কাজ হয়ে গেছে—তাদের নিজেদের কন্যাদের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, অন্যদেরকে সেই গল্প বলা।”
অ্যাপেইরোগোন উপন্যাসে মোট ১০০১টি অধ্যায় আছে। কোনো কোনো অধ্যায় এত ছোট যে একটা মাত্র বাক্য দিয়েই অধ্যায় শেষ। আবার কোনো অধ্যায়ে সেবাল্ডের মত শুধু ফটোগ্রাফ। আবার কোনো কোনো অধ্যায়ে শুধুই ফাঁকা পৃষ্ঠা—এই উপন্যাসের তল দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকা সেই গাণিতিক তত্ত্বের প্রতিচ্ছবি। আর উপন্যাসের মূল অধ্যায়গুলি এগিয়েছে মূল চরিত্র দুজনের ইন্টারভিউ দিয়ে—এই ইন্টারভিউগুলি ইমোশনালি খুব নাড়া দেয়। অথর’স নোটের এক জায়গায় ম্যাককান বলেছেন, বাসাম এবং রামি আমাকে এই বইয়ের অন্যান্য জায়গায় তাদের কথা ও তাদের দুনিয়াকে পুনর্নিমার্ণের অনুমতি দিয়েছেন।
এই বইয়ের ১০০১টি অধ্যায়ের একটি প্রতীকি তাৎপর্য আছে—সংখ্যাগতভাবে ১০০১টি আরব্য রজনীর সাথে মিল। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে জীবনকে বোকা বানানো। উপনায়সের শুরু হয় ২০১৬ সালের এক দিন, বেইত-জালার ক্রেমিসান মোনাস্ট্রিতে প্যারেন্টস সার্কেলের মিটিং-এ যোগ দিতে যায় বাসাম ও রামি। নিজেদের গল্পের ভিতরে আরেকটা গল্প খুঁজে পায় তারা… গল্প শুনতে শুনতে তারা স্মৃতিতে মনে করতে থাকে আরো অনেক গল্প, যেগুলি বলা হয়নি এখনো, কিন্তু হবে।
অ্যাপেইরোগোন উপন্যাসটির কাহিনি আগাতে থাকলে যত না উপন্যাসটা পড়া হয়, তার চেয়ে বেশি অনুভব হয়। বাসাম এবং রামির জীবনে চিরস্থায়ী হয়ে যাওয়া শোকের ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেমাদার ও আবিরের মৃত্যুর ঘটনা আরো অনেক গল্পের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়—যাদের জীবন ভালোভাবে শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেছে তাদের জীবনের গল্পগুলির সাথে এক শক্তিশালী সংলাপ চলতে থাকে। আমরা বাসামকে তার তরুণ বয়সে জেলখানায় বসে হলোকাস্টের ডকুমেন্টারি দেখার গল্প বলতে দেখি; জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আবিরের স্মৃতিবিজড়িত জায়গায় খেলার মাঠ তৈরি করতে আসা ইসরায়েলী সৈন্যদেরকে দেখি, আমরা দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাওয়া ভূগোল ও ইতিহাসের ট্র্যাজেডি পড়ি; অনেক উপরে ঝুলানো তার দিয়ে হেঁটে ফিলিস্তিন থেকে ইসরায়েলে আসা এক লোকের পাশে ঘোরাঘুরি করি, পাখিদের পাশে, বোর্হেস ও দারউইশের পাশে হেঁটে বেড়াই; ফিলিস্তিনের বর্তমান আবস্থা নিয়ে বলা কথা ও মতামতগুলি কোরাসের মত শুনতে থাকি।
অ্যাপেইরোগোন উপন্যাস এমন শোকের আবহে এগিয়েছে যে এটা হৃদয়কে ভারি করে তোলে। বাসাম এবং রামির বন্ধুত্ব দীর্ঘস্থায়ী সৌন্দর্যের একটা চিহ্ন। উপন্যাসের একটা জায়গায়, জার্মানিতে একটা ট্রেনে দুজন ঘুমিয়ে পড়ে—তুলনামূলক তরুণ বাসাম অপেক্ষাকৃত বয়স্ক রামির শরীরে ভর দেয়। এই উপন্যাস এই আপাতভাবে চিরস্থায়ী বিরোধের একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলির পরামর্শ দেয়— বন্ধুত্বের মত সহজ ও সরল একটা ব্যাপার, নিজেদের একই অভিজ্ঞতা শেয়ার করা এবং ভালৌবাসা। অনেকেই বলে থাকে, নিজেদের যে অভিজ্ঞতা হয় না তা নিয়ে কোনো লেখকের উপন্যাস লেখা উচিৎ না। কারণ তাতে উপন্যাসটা সস্তা আবেগপ্রবণ, ধ্বংসাত্মক ও নকল জিনিসে পরিণত হয়।
কিন্তু এই অ্যাপেইরোগোন এর ক্ষেত্রে তা হয়নি। যেসব উপন্যাস আপনি প্রায়ই দেখবেন, যেসবের ব্যাপারে প্রায়ই শুনবেন, এটা সেরকম না। বরং এটা একটা মাস্টারপিস জিনিস।
(দি গার্ডিয়ান থেকে অনূদিত)
লেখক পরিচিতি
আইরিশ লেখক কলাম ম্যাককান (Colum McCann) মূলত গল্প-উপন্যাস লেখেন। জন্ম. ১৯৬৫, আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে। এখন নিউইয়র্কে থাকেন। সেখানে হান্টার কলেজের ফাইন আর্টস বিষয়ের মাস্টার্স প্রোগ্রামে ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এ অধ্যাপনা করছেন। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক পিটার ক্যারি ও দ্য টাইগার্স ওয়াইফ-খ্যাত টি ওবরেহট সেখানে তার সহকর্মী।
Comments are closed.