বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধিৎসা নিয়ন্ত্রিত হলেও গবেষণার অর্থায়ন প্রায়ই প্রয়োগ-নির্ভর। এতে কি বিজ্ঞানের ক্ষতি হয়? হয়ত, বিশেষত বিনিয়োগকারী যদি ব্যবসায়ী হন। ঔষধ আর রাসায়নিক উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলি বিনিয়োগকারীর প্রয়োজনে বিজ্ঞানীকে দিয়ে ক্ষতিকর পণ্য উৎপাদন করিয়েছে। তামাক শিল্প গবেষণাকারীদের অর্থ সাহায্য দিয়েছে ধূমপানের ক্ষতি লুকাতে।
অ্যান ফিংকবেইনার
বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ নাওমি ওরেস্কেস-এর গবেষণায় জীবাশ্ম-জ্বালানি শিল্পে তামাকের ক্ষতিকর দিকের গ্রহণ স্পষ্ট। সায়েন্স অন এ মিশন (Science on a Mission) বইয়ে তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সামরিক অর্থায়নের জটিলতার বিষয়ে মনোযোগী। মনোযোগী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিজ্ঞানে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিনিয়োগ ও হস্তক্ষেপে। সমুদ্রবিজ্ঞানের কেস হিস্ট্রিভিত্তিক হলেও তার উপলব্ধির ক্ষেত্র বিভিন্ন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, আগে ও পরে যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্রবিজ্ঞানের মূল কেন্দ্র তিনটি। ক্যালিফোর্নিয়ার লা জোলার, স্ক্রিপ্স ইনস্টিটিউশন অফ ওশেনোগ্রাফি। উডস হোল ওশেনোগ্রাফিক ইন্সটিটিউটস, ম্যাসাচুসেটস। ল্যামোন্ট জিওলোজিকাল অবজারভেটরি, প্যালিসেডস, নিউ ইয়র্ক। তিনটি চমৎকার গবেষণা কেন্দ্রের সম্পূর্ণ অর্থায়নই যুক্তরাষ্ট্র নৌবিভাগের। নৌবিভাগের অর্থায়ন বিজ্ঞানের পথকে নিয়ন্ত্রণ করে কিনা? ওরেস্কেস বলেন―“হ্যা; যথেষ্ট।”
পানির নিচে শব্দ সঞ্চালন, সমুদ্রের তাপমাত্রা ও ঘনত্ব, সমুদ্র তলদেশের মানচিত্রের গবেষণায় নৌবাহিনী বিনিয়োগ করে। উদ্দেশ্য―শত্রুর আড়ালে সাবমেরিন চলাচল। গবেষণার বিষয় নৌবাহিনী-নির্ধারিত হলেও গবেষণাপদ্ধতি স্বাধীন। তা সত্ত্বেও ওরেস্কেসের দাবি, সামরিক অর্থায়নের উপস্থিতিই গবেষণার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপে যথেষ্ট; গুরুত্বপূর্ণ অনেক দিক অবহেলিত হয়।
১৯৩০ ও ১৯৬০-এ স্ক্রিপ্স ইন্সটিটিউশন অফ ওশেনোগ্রাফি ও উডস হোলে বিজ্ঞানীরাও সামরিক অর্থায়নের ব্যাপারে অভিযোগ আনেন। তাদের আশঙ্কা ছিল নৌবাহিনীর অর্থায়নের আসল উদ্দেশ্য বিশুদ্ধ বিজ্ঞানচর্চার বদলে প্রযুক্তির সামরিক প্রয়োগ। দুই পরিস্থিতিতেই বিজ্ঞানীরা হার মানেন। স্ক্রিপ্সে পদত্যাগ করেন পরিচালক, উডস হোলে বিজ্ঞানীরা। আরেকবার, পিছিয়ে পড়ে বিজ্ঞান। ১৯৬৪ সালে নৌবাহিনী, গভীর সমুদ্রে উদ্ধারকাজ ও শব্দ সংগ্রহে সক্ষম সাবমেরিন অ্যালভিনের অর্থায়ন করে। অথচ ১৯৭৪ সালে নৌবাহিনীর অর্থ সংকট ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়ার পরই কেবল অ্যালভিনকে প্রকৃত কৌতূহল-নির্ভর পর্যবেক্ষণ ও গভীর সমুদ্রের অণুজীবদের গবেষণায় ব্যবহার সম্ভব হয়। ১৯৭৪ সালের অর্থায়ন করে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন আর ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। দুটিই কৌতূহল-চালিত গবেষণা কেন্দ্র।
শোরগোল
ওরেস্কেসের সবচেয়ে জটিল ও দীর্ঘ গবেষণার বিষয় নৌবাহিনীর সমুদ্রপ্রবাহ বুঝতে চাওয়ার উদ্দেশ্য। উডস হোলের গবেষণা, বিশেষত হেনরি স্টোমেলের, থার্মোক্লাইন আবিষ্কার করে। সমুদ্রের উপরিভাগ, উষ্ণ আর নিম্ন শীতল অংশের মাঝের অঞ্চল থার্মোক্লাইন। থার্মোক্লাইনের তত্ত্বে―তাপমাত্রা কমলে ঘনত্ব ও প্রবাহ বাড়ে। ফলে শব্দের গতি প্রভাবিত হয়। নৌবিভাগের অর্থ সাহায্যে স্টোমেল থার্মোক্লাইন সার্কুলেশন মডেল বানান। মরিস ইউয়িং ও জো ওরজেল আবিষ্কার করেন সাউন্ড চ্যানেল। সাউন্ড চ্যানেলে সমুদ্রের নিচে নির্দিষ্ট অংশে দ্রুত শব্দ পাঠানোর পথ। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত এলাকা এড়িয়ে সাবমেরিনের আত্মগোপন ও যোগাযোগ সম্ভব হয়। নৌবাহিনীর প্রয়োজন আর সমুদ্রবিজ্ঞানীদের কৌতূহল মিলে সমুদ্র প্রবাহের বিজ্ঞানকে স্পষ্ট করে।
কিন্তু সমুদ্রে শব্দ গবেষণার অন্যান্য দিক অবিকশিত থাকে। ১৯৭৯ সালে স্ক্রিপ্সের ওয়াল্টার মাংক আর কেমব্রিজের কার্ল উনশ্ সমুদ্রের তাপমাত্রা ও শব্দের গতি পরিমাপ করেন। সিদ্ধান্ত নেন, ঠাণ্ডা পানিতে শব্দ দ্রুত চলে। পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি সমুদ্র। সমুদ্রের তাপমাত্রা ও শব্দের গতি গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক।
১৯৯৩, নৌবাহিনী সমুদ্রতলে অভিযানের সময়, তাপমাত্রা নির্ণয়ের এক কার্যক্রম শুরু করে। অভিযানে বিস্ফোরণের শব্দে সমুদ্রতলের প্রাণী, যেমন―তিমিদের, ক্ষতির ব্যাপার কার্যক্রমে জড়িত বিজ্ঞানীরা ছোট করে দেখান। রাজনৈতিক বিতর্ক, মিডিয়া ও জনগণের কলহ সৃষ্টিকারী এই কার্যক্রম এক দশক পর বন্ধ হয়।
সায়েন্স অন এ মিশন ইতিহাসের জরুরি গবেষণা, প্রাসঙ্গিক কাহিনী, বিবিধ দৃষ্টিভঙ্গির স্পষ্ট, মনোযোগী রচনা। কিন্তু নৌবিভাগের অর্থায়নে সমুদ্রবিজ্ঞানের ক্ষতির ব্যাপারে ওরেস্কেসের আলাপ উদ্ভটভাবে অসম্পূর্ণ মনে হয়। ক্ষতি প্রমাণে তিনি―সামরিক প্রয়োজনে অর্থায়ন আর বিশুদ্ধ কৌতূহলী গবেষণার মধ্যে অসম্ভব তুলনা ও পার্থক্য টানেন। সামরিক নিয়ন্ত্রিত বিজ্ঞান আর অভিযান-চালিত বিজ্ঞানকেও আলাদা করেন। ফলে, ওরেস্কেস কি পাঠককে জলবায়ু পরিবর্তন বা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন আবিষ্কারে একই সামরিক অবহেলা, প্রভাব আর ক্ষতির ইঙ্গিত দিতে চান?
যদি তাই চান, ক্ষতি কী? বইয়ে ওরেস্কেস যে সমস্যা ইঙ্গিত করলেও সমাধান দেন না―বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্র ভিন্ন ভিন্ন গবেষণায় মনোযোগী। কোনো ক্ষেত্র প্রায়োগিক প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয়, কোনো ক্ষেত্র প্রায়োগিক দিক উপেক্ষা করে মনোযোগী বিশুদ্ধ কৌতূহলী গবেষণায়। আরেকটা সমস্যা, সামরিক বাহিনীর সাথে কাজের ব্যাপারে সংস্কার। সবসময় সামরিক অর্থায়নে অভিযানকেন্দ্রিক গবেষণাকে অবিশ্বাসের চোখে দেখা কখনো বিজ্ঞানেরই ক্ষতির কারণ হতে পারে। ওরেস্কেস কি অনিবার্য সামরিক অর্থায়নে চালিত সমুদ্রবিজ্ঞান চর্চাকে অবিশ্বাসের চোখে দেখতে বলেন? এই প্রশ্নের উত্তরই হয়তো আলাদা আরেক বইয়ের বিষয়।
সূত্র. নেচার, ৪ মে ২০২১
অনুবাদ: সাব্বির পারভেজ সোহান
.
Science on a Mission:
How Military Funding Shaped What We Do and Don’t Know about the Ocean
By: Naomi Oreskes
ISBN: 9780226732381
ভাষা: ইংরেজি
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৭৪৪
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২১
প্রকাশক: দি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস
দেশ: ইউএস
প্রথম সংস্করণ
Comments are closed.